সিলেট প্রতিনিধি:-
সর্বকালে সকল সমাজেই কিছু ভালো মানুষ থাকেন যারা নামে-দামে খুব খ্যাতিমান কেউ না হলেও নন গুণে-মানে নীরবে-নিভৃতে সমাজের আলোকশিখা হয়ে দীপ্যমান থাকেন। আমরা ভাষার সৌকর্য আর সুনামে সিক্ত করে তাদের বলি ‘সাদা মনের মানুষ’। তাদের অনেকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন, এখনও আছেন, শহর-নগর থেকে দূরে, গ্রামে-গঞ্জে, নিভৃত জনপদে। তেমনি একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার গোয়াসপুর গ্রামের আলহাজ্জ মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির। এখনো এলাকাবাসীর মন জুড়ে রয়েছেন এই সদালাপী, নিরহংকার ও অসাধারণ মানুষটি।
প্রথাগত বিখ্যাত কেউ নন তিনি, কিন্তু মুক্ত চিন্তা-চেতনায় লালিত, নাগরিক জীবনের বাইরে, নগর থেকে দূরে গ্রামীণ পরিবেশে জীবন অতিবাহিত করা একজন সহজ সরল জীবিনের অধিকারী নিরেট ধার্মিক ও আপাদমস্তক সামাজিক বুদ্ধিজীবী। জীবনাচরণে মননশীল, সহজ-সরল, মানসিকতায় উজ্জীবিত মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির নীরবে-নিভৃতে যাপিত জীবনের ‘সত্যিকার ভালো মানুষ। সম্প্রতি জীবনের পাট চুকিয়ে মহান প্রভুর ডাকে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।
একজন হৃদয়বান মানুষের জন্য শোকগাঁথা লিখতেই এ নিবন্ধের অবতারণা। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার গোয়াসপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি যখন জন্মগ্রহন করেন তখনকার সময়ে সেই জনপদ ছিল সত্যিকার অর্থেই অজপাড়াগাঁ, এখন সেই অজপাড়াগাও উন্নয়নের জোয়ারে লেগেছে শহরের ছোঁয়া। গোয়াসপুর গ্রামের অজপাড়াগাও থেকে উন্নয়নের ছোঁয়ার নিরব সাক্ষী মহৎ হৃদয়ের ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির।
শত বঞ্চনায় অভিমান হীন মহত্ব ত্যাগে মহান,
সাদা মনের আলোকশিখা সরল জীবন যাপন।
এলাকার সকলের প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকতেন সবসময়। এলাকার সর্বসাধারণের প্রয়োজনে সদা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকতো। হাসি ছাড়া তিনি কথা বলতেন না। তার আচার-ব্যবহারের কথা স্বরন করে আজও মুগ্ধ হয় তার নিজ এলাকাসহ ইউনিয়নের সর্বস্থরের মানুষ। এছাড়াও তিনি তার এলাকার স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা,, ঈদগাহ ও কবরস্থানের উন্নয়নের নিবেদিত প্রান ছিলেন। নিঃস্বার্থ ভাবে অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে সব সময় নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। তিনি কখনো কাউকে খালি হাতে ফিরাতেন না। এই সদালাপী নিরহংকার মানুষটি এলাকার সমবয়সীদের কাছে বড় ভাইসাব নামে খ্যাত। মানুষের হৃদয় জুড়ে রয়েছে তার প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির ১৯২৬ ইং সালে গোয়াসপুর গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম আব্দুস শহিদ লস্কর। তিনি ১৯৩৭ সালে স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ধর্মীয় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য সিলেটের অন্যতম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা উত্তর রানাপিং আরাবিয়্যা হুসাইনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিন্তু দেশের উত্তাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশিদুর পর্যন্ত লেখাপড়া করা হয়নি। ১৯৬৭ সালে তিনি জাহাজের কাজে যোগদান করেন। কিন্তূ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চাকুরী ছেড়ে চট্রগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধের সময় তিনি পাকবাহিনীর হাতে বন্দী হন। যুদ্ধ শেষে অনেকে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পেলেও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমানাদির অভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা খেতাবপ্রাপ্ত হননি। এজন্য তিনি আফসোস করে নিজেকে সান্তনা দেওয়ার জন্য প্রায়ই বলতেন আমি যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য খেতাবের জন্য নয়। তিনি পারিবারিক জীবনে আট পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন।
আলহাজ্ব মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির লস্কর স্বভাবগত ভাবেই অসহায় মানুষের বন্ধু। তিনি কারো অভাব দেখলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি নিজের অর্জিত টাকা অসহায় মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। স্বাধীনতার পর তিনি কৃষি কাজে মনযোগ দেন। এলাকার মানুষ তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। এছাড়াও ছোট ছেলে-মেয়েরাও তাকে বন্ধুর মতো ভালোবাসতো। ছোট ছোট শিশুদের প্রতি তার মহব্বত দেখলে মনে হত তিনি যেন পাড়ার সকল কোমলমতি শিশুদের অতি আপনজন। দুনিয়ার প্রতি উদাসীন এক নির্লোভ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির।
এলাকার শান্তি শৃঙ্খলার জন্য সব সময় কাজ করতেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সব সময় সহযোগিতা করতেন। অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে থেকে তাদের আর্থিক সহযোতিা করতেন নিঃস্বার্থভাবে। তারমধ্যে কোন লোভ-লালসা ছিলনা। তিনি কখনো কোন মানুষের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতেন না।
এলাকার লোকের ভাষ্যমতে, মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির অত্যন্ত সহজ-সরল, সদালাপী হাস্যজ্জল একজন মানুষ, সামাজিক, মিশুক, হাস্যজ্জল, পরোপকারী ও সদালাপী একজন লোক। জনপ্রতিনিধি না হয়েও যে সমাজের সেবক হওয়া যায় তার জ্বলন্ত উদাহরন মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির। তার বর্ণনা দিয়ে শেষ করার মতো নয়। সমাজটাকে সুন্দর রাখতে আমাদেরও তার মতো মানুষ হওয়া উচিত। সব ধরণের মানুষের সাথে চলতে পারতেন। অসহায়দের সহযোগিতা করতেন। দলমত নির্বিশেষে সবার সাথে ছিলো তার ভালো সম্পর্ক।
এলাকাবাসীর মতে তিনি ব্যক্তি জীবনে আপাদমস্তক একজন মাঁটির মানুষ। সহজেই মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসাধারণ এক গুন ছিলো তার। জীবনের শেষ সময়ে তিনি শাহজালাল উপশহরে বসবাস করেন। উপশহরে বসবাস করলে তার চিন্তাচেতনায় সদা বিরাজ করতো গ্রাম ও গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়না মিয়া। তিনি বলেন, মোহাম্মদ আব্দুল মছব্বির অসাধারন এক বক্তিত্ব ছিলেন। মানুষের জন্য কিছু করার আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো তার। মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে তার ভালো লাগতো। মনে তৃপ্তি লাভ করতেন। তিনি তার আশেপাশের মানুষজন, পাড়া প্রতিবেশি ও এলাকার মানুষদের মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। প্রতিবেশীদের শত আঘাত তাহার কাছে তুচ্ছ মনে হত। কেউ কষ্টে থাকলে তিনি সহ্য করতে পারতেন না।
এলাকার মানুষের জন্য সর্বদা তার মন কাঁদে। তাই তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে, মানুষের সাথে মিলেমিশে থেকেছেন। আমি মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন তাহাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম জান্নাতে ফেরদাউস দান করেন।
আজকের নলজুর/২৪অক্টোবর২৩/বিডিএন