1. admin@ajkernaljur.com : admin :
জগন্নাথপুরের সড়ক উন্নয়ন এবং স্মৃতির ঢাক-ঢোল - আজকের নলজুর
২৭শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ| ১৩ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ| বর্ষাকাল| শুক্রবার| ভোর ৫:৪৯|

জগন্নাথপুরের সড়ক উন্নয়ন এবং স্মৃতির ঢাক-ঢোল

রিপোর্টার
  • আপডেটের সময় : শনিবার, নভেম্বর ২৫, ২০২৩,
  • 238 দেখা হয়েছে

“আব্দুল মুকিত মুখতার (লন্ডন থেকে)”

(এক)-
গত শতাব্দির সত্তর সালের শীতকাল। বোনের বাড়ী সুনামগঞ্জ শহরে যাবার প্রস্তুতি চলছে। আমরা তিন ভাই ও একমাত্র বোনের মধ্যে আমিই সকলের ছোট। তাই মায়ের একটু বেশী আদুরে সন্তান আমি। ভাইদের সাথে আমিও যেতে চাই। সাথে সাথে মায়ের ললাট- খেঁচা আপত্তি। কোথায় জগন্নাথপুর আর কোথায় সুনামগঞ্জ! একেতো পায়ে হাঁটা পথ। পথে–ঘাটে কত আপদ-বিপদ! বাপরে বাপ! নাম শুনতেই ভয় লাগে, কণ্ঠনালি শুকিয়ে যায়!

মাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। তাঁর একটাই কথা, ‘তোরা যেতে চাস, যা, কিন্তু একে যেতে দেবো না। শুনেছি রাস্তায় ছয়ারা’র পুল পাওয়া যায়। ওতে নাকি ‘আইয়ুবের ভূত’ থাকে।’ মায়ের ভূতাতংকে সবাই হাসলেন। বড় ভাই বললেন, তাতে কি হলো। আমরা ওই পুলের উপরে হাঁটবো নাকি? ওটাতো মাটি থেকে অন্তত পঞ্চাশ- ষাট ফুট উচুঁতে! যা হোক, শেষ পর্যন্ত মা রাজী হলেন। তবে শুধুমাত্র আমাকে দেখবাল করার জন্য সাথে লাগিয়ে দিলেন পড়শী ‘মছলন্দর’ ভাইকে। তিনি আমার থেকে তিন-চার বছরের অগ্রজ।

আমার বয়স তখন তের। ফজরের আযানের পর পরই নামায আদায় করে আমরা রওয়ানা দিলাম। আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে যে, অনেক গ্রাম ও বাজারের নাম এখন আর আমার মনে নেই। আমরা জগন্নাথপুর বাজার মসজিদের পাশ দিয়ে উত্তরমুখী হতেই সূর্যোদয় হলো। ইতোমধ্যে আরো কিছু মানুষের দেখা পেলাম। ওরাও সুনামগঞ্জ যাচ্ছেন। কৃষিপ্রধান এলাকা তাই কেউ কেউ আবার গরু নিয়ে চলেছেন ক্ষেতের কাজে। একটা মাত্র সড়ক। সকলের জন্যই উন্মুক্ত। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।

নলজুর নদীর একটি শাখানদী আলখানা গাঙ্গ। আলখানা গাঙ্গের উৎসমুখে হেমন্তকালে বাসের পুল তৈরী হতো। ঐ স্থানটির একটা সুন্দর নামও ছিলো। এখন আর তা মনে নাই। (একসময়ের সহপাঠি হামজা ও মতিউরকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাদেরও জানাই। বর্ষাকালে এখানটায় খেয়া নৌকা চলতো। শুনেছি এই আলখানা গাঙ্গ এক সময় ‘রত্নানদী’ নামে প্রবাহিত হতো।

অন্তত সহস্রাব্দকাল আগে এই রত্নানদী বহেছিল ভবানীপুর গ্রামের মাঝখান দিয়ে চিলাউড়ার পশ্চিমে ‘হন্দল’ পর্যন্ত। রত্না নামের নদীটি সম্ভবত এখনো পাটলী ইউনিয়নে প্রবহমান রয়েছে। আলখানা নদীর ভিন্ন ইতিহাসও প্রচলিত আছে যে, নলুয়া হাওরে চলাচলের জন্য এককালে একটি আইল খনন করা হয়েছিল। বর্ষাকালে আইল কাটা খালের সাথে নলজুর নদীর সংযোগ সৃষ্টি হয়। পানির তোড়ে সেটি ধীরে ধীরে নদীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

এগুলো লোকমুখে প্রচলিত ইতিহাস। তবে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে স্থানে মাটি কাটা হয় তা কিন্তু অত্যন্ত অদূরদর্শী। এবং মাঝে মধ্যে তা বিপজ্জনক রূপ ধারণ করে। শীত-বসন্তের শুকনো মৌসুমে মাটি কেটে মাত্র তিন-চার ফুট দূরে সড়ক নির্মাণ করা হয়। মনে হয় যেনো খালটি খনন করা হয়েছে সড়কটি ভেঙ্গে পড়ার জন্য। ঠিক তা-ই ঘটে।

গ্রীষ্মকালের ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে সড়ক ভেঙ্গে খালে পড়ে। বর্ষাকাল শুরু হওয়া সাথে সাথেই নবনির্মিত সড়ক পানি ও মাটির সাথে হাঁরিয়ে যায়। কোন কোন স্থানে সড়কের খাল খড়স্রোতা নদীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ঘর—বাড়ি তছনছ করে দিয়েছে। সে এক ভিন্ন ইতিহাস।

(দুই)-
আমরা কলকলিয়া পাড়ি দিয়ে ডাউকা বা ডাহুকা নদীর খেয়াঘাটে পৌঁছলাম। খেয়া পারাপারের অপেক্ষার সুযোগে সাথে থাকা চিড়ামুড়ির নাস্তাও সেরে নিলাম সকলে মিলে। সে সময় মনের মাঝে একটা আতংক বিরাজ করতো সব সময়। শুনেছি নদীর ডহরে নাকি ‘মাল’ থাকে। অবশ্য ‘মাল’ শব্দটি কিছু একটা আছে অর্থে প্রচলিত! সুতরাং গ্রাম্য ভাষায় যাকে ‘মাল’ বলা হয়, পরবর্তীতে জেনেছি সেটা হলো ‘ডহরদেও’ কিংবা পানির নিচের দেও বা দৈত্য।

অনেক গালগল্প শুনেছি নদীর ‘ডহরদেও’ বা ‘দৈত্য’ সম্পর্কে। স্রোতবিহীন নদীর ‘ডহরদেও’ নাকি আরো বেশি ভয়ঙ্কর। হঠাৎ পানিতে ঘুর্ণন সৃষ্টি করে সমস্ত নৌকা টেনে নিয়ে তলিয়ে যায় দশ হাত পানি নিচে। এমনকি জাহাজের মতো নৌকাগুলোও টেনে নিয়ে যায়। নদ- নদীর ডহরে নাকি জলরাজার রাজত্ব রয়েছে। সেখানে নাকি জলপরীদের বসবাস। নৌকাডুবিতে যারা জলরাজার প্রহরীদের খপ্পরে পড়ে, তারা বাঁচতে পারে না। তিন চার দিন পর তাদের লাশ ভেসে ওঠে ভাটি এলাকায়।

কিছুটা অতিরঞ্জিত গল্পগুজব হলেও মাঝেমধ্যে সত্য ঘটনাও আছে বলেও শুনেছি। ডাউকা নদীর ফেরী নৌকায় বসে চারিদিকে তাকাচ্ছি আর ডহরদেও আতংকে শরীরে একপ্রকার কাঁপ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কাউকে তখন বুঝতে দেইনি।
আমরা ডাউকা নদী পাড়ি দিয়ে হাঁটছি। দুর্গম হাওরের রাস্তা। চারি দিকে ফসলের জমি, আইল এবং মানুষ চলাচলের পথ। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো সেই ঐতিহাসিক ব্রিজ।

জগন্নাথপুর টু সুনামগঞ্জ রোডে এরকম কয়েকটা ব্রিজ তৈরী করা হয়েছিল সেই যুগে। অর্থাৎ আইয়ুব খানের শাসনামলে। তখন সুনামগঞ্জ ছিল মহকুমা শহর। জগন্নাথপুরের সাথে সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি করার জন্যই এই ব্রিজগুলো তৈরী করা হয়েছিল। অতিব দূর্গম এই পথ পাড়ি দিয়ে শত শত লোক হর-হামেশা সুনামগঞ্জ যাতায়াত করতেন। অনেককে সরকারী দায়গ্রস্ততায় বাধ্য হয়ে সুনামগঞ্জ যেতে হতো।

এমনও গল্প শুনেছি যে, সুনামগঞ্জের আদালতে দাঁড়িয়ে উকিল সাহেব বিচারপতি বললেন, ‘আমার মক্কেল জগন্নাথপুর থেকে আসার পথে ছয়ারার ব্রিজে উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে যায়। তাই তার হাত মচকে গেছে। এই দেখুন, তার হাতে বেন্ডেজ বাঁধা। এইজন্য তিনি সময়মতো হাজির দিতে পারেন নাই। অতএব বিচারক যেনো এই দুর্ঘটনার প্রতি নজর দিয়ে সদয় হন।’ সাথে সাথে বাদীপক্ষের উকিল ভ্যাটো দিয়ে বললেন, ‘ছয়ারা ব্রিজ তো মাটি থেকে অন্তত চল্লিশ ফুট উপরে। তা আপনার মক্কেল এতে উঠলো কিভাবে।’ প্রতিত্তোরে বলা হলো, ‘উঠতে পারেনি বলেই তো দুর্ঘটনা।

সে যাক! অত্যন্ত দুর্গম এই সড়ক। সে যুগে কেউ কখনো একা একা এই পথ ধরে হাঁটতেন না। অনেক সময় দু’তিন জনের সঙ্গবদ্ধ চলাচলেও ছিল ভিন্ন রকমের আপদ বিপদ আতংক। চোর- ডাকাতের সাথে সাথে বিষধর সর্প, জঙ্গলী শূয়র, খেঁকশিয়াল, নেকড়ে, কূপিবাঘ এমনকি চিতাবাঘ পর্যন্ত থাকতো রাস্তার পাশের নল-খাগড়া বন-জঙ্গলে। ‘দেকার’ হাওরসহ এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে ছন, নল ও খাগড়া ফলতো।

তাই-‘ছন বনে বাঘ থাকে, পথ চলো দেখে শুনে’ এরকম প্রবাদও প্রচলিত ছিল। যা তখনকার দিনের জগন্নাথপুর টু সুনামগঞ্জ রাস্তার সবচে বড় আতংক। বর্ষকালে এই এলাকার প্রায় প্রত্যেকটি বাজার ছিল ‘ছন’ এর জন্য প্রসিদ্ধ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা এসে ছন কিনে নিতো।

এই রাস্তার অসহায় পথিকদের দূর্গতি লাঘবের জন্যই সে যুগের নেতাকর্মীরা উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন। তৈরী করেছিলেন আকাশচুম্বি ব্রিজ। যেমন ছায়ার’র ব্রিজ অথবা বম্বমি’র পুল। প্রত্যেকটি ব্রিজই স্থলভূমি থেকে অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট উচুঁতে নির্মিত হয়েছিল। তখনকার কোন্ কোন্ কর্মকর্তার নির্দেশে যে এই নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছিল তা কাবুলীওয়ালা ছাড়া আর কেউ জানেনা। কাবুলীওয়ালা এই কারণে বললাম যে, পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের সড়ক উন্নয়নে এমন কিছু কিছু কাজ করে জনগণের রক্তচোষা অর্থের অপচয় হয়েছে, যা আজ ভাবতেও ঘেন্না লাগে। কাবুলীওয়ালাদের সাথে তথাকথিত কিছু সংখ্যক অদূরদর্শী এবং ঘুষখোর কর্মীও জড়িত ছিলেন।

যে ব্রিজগুলোর দিকে তাকিয়ে পথিকরা পাকা সড়কের স্বপ্ন দেখতেন। পরবর্তীতে আমরাও দেখেছি। আমাদের জানামতে এ রাস্তার নিয়মিত পথিকদের অধিকাংশের ইতোমধ্যে জীবনাবসান ঘটেছে, কিন্তু পাকা সড়ক দিয়ে চলাচল করে যেতে পারেননি। শুনেছি জগন্নাথপুর টু সুনামগঞ্জ পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য বিরাট অংকের অর্থ বরাদ্দ হতো প্রতিবছর। অতি চালাক নেতাকর্মীরা এই ব্রিজগুলোর ছবি দেখিয়ে হাজার হাজার (সাম্প্রতিককালের কোটি কোটি) টাকা প্রতিবছর সরকার থেকে লোপাট করেছেন।

স্থানে স্থানে কিছু মাটি ভরাট করেছেন জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে। বাদবাকী বরাদ্দ সম্ভবত রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকা শেঁয়াল, নেকড়ে কিংবা কাবুলীওয়ালারা খেয়েধেয়ে পালিয়ে গেছে। আমরা হাঁটছি তো হেঁটেই চলেছি গন্তব্যের দিকে।

(তিন)-
পথিমধ্যে জোহরের আযান শোনেই ভাইদের মাঝে বলাবলি শুরু হলো। আমরা নাকি অনেক দেরি করে ফেলেছি। ইতোমধ্যে জগন্নাথপুরের অনেক যাত্রী সুনামগঞ্জ পৌছে গেছেন। কেউ কেউ হয়তো নাকি তাদের অফিসিয়েল কাজ সেরে ফিরতী যাত্রা শুরু করেছেন। ইত্যাদি অনেক আফসোস। অনেক মন্তব্য। তখন বুঝতে পারি নি কি কারণে এ আলোচনা হচ্ছিল। আমার ধীর গতির হাঁটা যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তা দীর্ঘকাল পরে অনুধাবন করতে পেরেছি।

আমরা মহাশিং নদীর ফেরীঘাটে পৌঁছলাম। এই রাস্তার সবচে বড় নদী এটি। বিশাল গুদারা চলে পারাপারের জন্য। অবশ্য নদীতে তখন স্রোত ছিল না। তারপরও তিন চারজন মাঝিমাল্লা নৌকাটি নিয়ন্ত্রণ করে এবং চালায়। অত্যন্ত সুপরিচিত সুনামগঞ্জ জেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নদী, মহাশিং। বিভিন্ন নামে ভারত থেকে বহে আসা এই নদীটি দু’টো দেশ ও বিশাল দু’টো হাওরের মাঝে সংযোগ সৃষ্টি করেছে।

একটি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নলুয়া, যা জগন্নাথপুরের বৃহত্তম হাওর হিসেবে খ্যাত। এই মহাশিং নদীটি ‘দেকার’ হাওরের মধ্য দিয়ে তেলিকোণা থেকে ডাউকা বা ডাহুকা নদী নাম ধারণ করেছে। তারপর কামারখাল হয়ে নলুয়া হাওরের পশ্চিম তীরে বুরাখালি গ্রামের কাছে গিয়ে আবার নাম পরিবর্তন করেছে।

আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত এই মহাশিং নদীর তীরেই সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে রায়পুর বড় মসজিদ। অনেকটা যমুনা তীরের তাজমহলের মতো। কালের সাক্ষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনাব ইয়াসীন মির্জা। তিনি এই এলাকা তথা তখনকার সুনামগঞ্জ মহকুমার সবচে বড় ব্যবসায়ী এবং ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটি নির্মাণ করতে তাঁর খরচ হয়েছিল ১০ লক্ষ টাকা।

সময় লেগেছিল প্রায় ১০ বছর। সবচে মজার ব্যাপার হলো, এই মসজিদটির আর্কিটেক্ট বা স্থপতি ছিলেন জনাব মুনীম আসগর। যিনি ছিলেন আগ্রার তাজমহল নির্মাতাদের একজনের উত্তর পুরুষ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের সমাজে একটা অসত্য ইতিহাস প্রচলিত আছে। যেমন- ‘আগ্রার তাজমহল নির্মাণ করতে ২২ হাজার শ্রমিক ২০ বছর কাজ করেছিলেন।

পরবর্তীতে বাদশাহ শাহজাহান সকল শ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিলেন, যেনো তারা আরেকটা তাজমহল কোথাও বানাতে না পারে।’ এটি বাদশাহ শাহজানের বিরুদ্ধে একটি ডাহা মিথ্যা অপপ্রচার। কারণ, যে মানুষ একটা কবরস্থানকে স্মৃতিময় করে রাখার জন্য তাজমহল তৈরী করেছিলেন, সে মানুষ কিভাবে এতো জুলুমবাজ হন? বোধগম্য হতো না।

২০১৫ সালে আমি আগ্রার তাজমহল ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আমাদের গাইড ছিলো একজন মুসলিম তরুণ। প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, বাদশাহ শাহজাহান কিভাবে ২২ হাজার শ্রমিকের হাত কেটেছিলেন, সে স্থানটি আমি দেখতে চাই। আমার এই প্রশ্নে বিব্রতবোধ করে গাইড বললো, দয়াকরে আমাকে এরকম মিথ্যা এবং আজগুবি প্রশ্ন করবেন না।

আপনাদের বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণকারী কিছু কিছু লোক এই প্রশ্নই করেন। কোথায় যে তারা এগুলো শোনেন, আমরা বুঝি না। আমিও এই শ্রমিকদের একজনের সন্তান। আমাদের বংশের অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো স্থপতি শিল্পে কর্মরত রয়েছে। এখানে আমরা সেই আদিকাল থেকেই বসবাস করছি। এরকম কথা তো আমরা কোনদিন শুনিনি যে, আমাদের পূর্বপুরুষের হাত কাটা হয়েছিল!

আমরা তখন ছয়ারা ঘাটে মহাশিং নদী পাড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাবর পয়েন্টে এসে পৌঁছি। সিলেট টু সুনামগঞ্জ সড়ক। জেলা শহরের সাথে মহকুমা শহরের যোগাযোগের কারণে এটিকে মহাসড়ক বলাই সমিচীন। যদিও গবিন্দগঞ্জ থেকে পাগলা পর্যন্ত সড়কটি তখনও সম্পূর্ণ পাকা হয়নি। প্রস্তর-নুড়ি দিয়ে বাঁধাই করা। স্থানে স্থানে পিচঢালা হচ্ছে। তবে ধীর গতিতে ঢালাই কাজও চলছে। অবশ্য পাগলা টু সুনামগঞ্জ শহর পর্যন্ত সড়কটি পিচঢালা। ডাবর পয়েন্টে গাড়ী পাওয়া গেলো না। বেশ ক’টা গাড়ীই সুনামগঞ্জ গেলো, কিন্তু চারজন যাত্রীর জন্য সিট খালি নেই।

শেষ পর্যন্ত আমরা পাগলা বাজার গিয়ে সেখান থেকে সুনামগঞ্জ যাত্রা করি। তখন আছরের আযান হচ্ছিল। কিছুদূর যেতেই ‘আসানমারা’ ফেরীঘাট। তথাকথিত মহাবিপদের আরেক হেড কোয়ার্টার। অত্যন্ত গভীর একটি খাদ হচ্ছে আসানমারা। বর্ষাকালে মারাত্মক রকমের স্রোত থাকে সেখানে। প্রতি বছরই সেখানে নৌকাডুবি, ফেরী দুর্ঘটনা ঘটে।

শুনেছি এককালে সে স্থানে একটি ছোট খাল ছিল। হাসান বা আসান নামক এক ব্যক্তি মাছ ধরতে গিয়ে খালে ডুবে মারা যায়। লোকটি যখন পানিতে হাবুডুব যাচ্ছিল, তখন খালের পারের লোকেরা ধারণা করেছে যে, আসানকে ‘মাল’ বা ‘জলদেও’ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। দিনে দুপুরে অনেক লোকের সামনে আসান নামক ব্যক্তিটি তলিয়ে যায়। সেই থেকে এটি আসানমারা নামে খ্যাত।

আসানমারা ফেরীঘাট এলাকায় স্থানীয় মানুষের মাঝে গা—শিউরে আতংক। দিনরাত এখানে ফেরী পারাপার হয় এবং প্রায়সই দুর্ঘটনা ঘটে। বেশীর ভাগ নৌকা ডুবি ও মানুষ মারা যায় বর্ষাকালে। আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ীটি ফেরীতে উঠলো। বিরাট বিরাট দু’টো নৌকাকে একসাথে বেঁধে তৈরী করা হয়েছে ফেরী বুট। ইঞ্জিনের সাহায্যে এটি চলাচল করে। ফেরী নৌকায় দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকাচ্ছি আর মনে মনে ‘খত্মে ইফনুস’ পড়ছি। নিবৃত্ত নদের পানিতে হঠাৎ যদি ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়ে ফেরী ডুবে যায়, তাহলে তো সর্বনাশ!

‘সুব’হানাকা’ পড়তে পড়তে ফেরী ঘাটে ভিরলো। আমরা সাথে সাথে তীরে উঠলাম। আমাদের গাড়ীটি সুনামগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করলো। চারিদিকে শুধু হাওর, বন—বাদাড় ও ধান ক্ষেত। মাঝে মধ্যে জলরাশিও চোখে পড়ে। জেলেদের মাছ ধরা নৌকা এবং বিরাট জাল পাতা রয়েছে। ‘দেকার’ হাওরের পশ্চিম তীর ঘেসে মহাসড়ক চলছে।

শহরতলীতে দেখলাম সুনামগঞ্জ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিশাল কল দিয়ে পানি তোলা হয় একটি পাকা পুকুরে, এতে তৈরী হয় বিদ্যুৎ। যা শুধুমাত্র শহরের কিছু অংশে আলো দিতে পারে। আমার কাছে খুবই চমকপ্রদ লেগেছিল নগর বিদ্যুতায়ন প্রক্রিয়া। তারচে বেশী চমৎকৃত হয়েছিলাম রিক্সা চলাচল প্রত্যক্ষ করে। জগন্নাথপুর টু সুনামগঞ্জ পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ, রিক্সা ইত্যাদি শুধু সেদিন স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্নের মতো ছিল তখন।

উল্লিখিত ছয়ারা ব্রিজগুলো দেখে অনেকদিন তিরষ্কার করেছি। অতীতের কিছু সংখ্যক নেতৃবৃন্দকে চোর- ডাকাত ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছি। আমার মতো অনেকেই এই ব্রিজগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। নিশ্চয়ই এখনো মনে পড়ে অতীতের সেই জগন্নাথপুর টু সুনামগঞ্জ দূর্গম রাস্তার কথা! কিন্তু তারপরও আজ তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। তবুও তারা আমাদের পূর্বসূরী। অবশ্য তাদের অপকর্মের উত্তরসূরী আমরা হতে চাই না।

সেদিন যদি তারা স্বদেশ প্রেমের মানসিকতা নিয়ে সত্যিকার উন্নয়নমূলক কাজ করতেন, তাহলে আরো অন্তত কুড়ি বছর আগে এগিয়ে যেতো আমাদের জগন্নাথপুর উপজেলা। জগন্নাথপুর হয়ে উঠতো অত্যাধুনিক একটি মডেলসিটি।
তারপরও সেদিন তারা যদি গভীর হাওরের মধ্যখানে অকেজো ব্রিজগুলো তৈরী করে পাকা সড়কের স্বপ্ন না দেখাতেন, তাহলে আজ এই স্থান দিয়ে গাড়ী টেম্পু রিক্সা ইত্যাদি চলাচল করতো না। হাওরের মাঝে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলতো না। জগন্নাথপুরকে মড়েল সিটি বানানোর স্বপ্নও দেখতে শুরু করতাম না।

কথায় বলে, ‘চোর যখন চুরি করে পালায় / পিছনে কিছু বুদ্ধি রেখে যায়।’ আমাদের পূর্ব প্রজন্মের অধিকাংশ গম চোর-বাটপারদের রেখে যাওয়া বুদ্ধির ভেতর থেকেই জগন্নাথপুরকে মডেলসিটি বানানোর পথিকৃত বলা যেতে পারে। সেদিক থেকে তাদেরকে ধন্যবাদ।

লেখক: আজকের নলজুর পত্রিকার- প্রধান সম্পাদক আব্দুল মুকিত মুখতার।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরণের আরো খবর
© All rights reserved © 2023 আজকের নলজুর
Design and developed By: Syl Service BD